বুদ্ধমূর্র্তির উৎপত্তি ও ইতিকথা
September 25, 2021সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক ভাবনা
September 25, 2021
মহামানব বোধিসত্ত্ব বুদ্ধাংকুর হিসেবে জন্ম-জন্মান্তরের পারমী সম্ভার পূর্ণ করে শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোধনের ঔরষে রাণী মহামায়ার গর্ভে সিদ্ধার্থ হিসাবে জন্মগ্রহণ করে অতি আদর যত্নে রাজকুমারের বেড়ে উঠা। জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদগণের গণনানুসারে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছিল এই সন্তান সংসারে থাকলে রাজচক্রবর্তী রাজা ধার্মিক রাজা হবে, আর সংসার ত্যাগ করলে জগৎ পূজ্য বুদ্ধ হবে। সিদ্ধার্থের বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণানুসারে সংসারী হওয়ার চেয়ে সন্যাসী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। একথা শুনার পর রাজপরিবারের সকলে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাজ সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী তিনিও যদি সন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন, এই রাজপরিবার, রাজসিংহাসনের ও রাজ্যের কি হবে? বিজ্ঞ জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদেরা বলে ছিলেন, চারি নিমিত্ত দর্শন করে রাজপুত্র গৃহ ত্যাগ করে সন্যাস ধর্ম অবলম্বন করবেন, জড়া, ব্যাধি, মৃত্যু ও সন্যাসী। রাজমশাই এই চারি নিমিত্ত যাতে করে রাজপুত্রের চোখে না পড়ে তার যথাযথ ব্যবস্থা করার পরও সম্ভব হয়নি। এই নিমিত্ত গুলো দর্শন করার পর তিনি রাজপরিবার, রাজসিংহাসন, রাজভোগ, রাজসুখ স্ত্রী-পুত্র সব কিছুর মধ্যে অনিত্য-দুঃখ ও অনাত্ম অনুভব করলেন। সবই দুঃখ! এই দুঃখ থেকে নিবৃত্তি চাই। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার জ্যোস্না স্নাত রাতে সকলের মায়া ত্যাগ করে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন।
গৃহত্যাগ করার পর অনেক ঋষি ও মুণিঋষির স্বাক্ষাৎ হয়, তাঁদের নানা রকম শিক্ষা ও সাধনা পদ্ধতি তিনি শিক্ষা করেন, কোনটাতে ভাবী বুদ্ধের মন বসে না এবং এই শিক্ষা ও সাধনার দ্বারা সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করা দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজে নিজে বহুপথ প্রান্তর ঘুরে ঘুরে অতি কৃচ্ছতা সাধনার দ্বারা তিনি শুকিয়ে চর্মসার হয়ে গিয়েছিলেন, এক বীণা বাদক বীণার তার একে বারে ঢিলা করে দিয়ে বাজিয়ে শুনালেন এতে কোন সুর ছন্দ নেই, আবার একেবারে টান-টান করে বাজিয়ে শুনালেন, তাতেও কোন সুর ছন্দ নেই, যখন বীণার তার ঢিলাও নয় একেবারে টান-টানও নয় মধ্যম ভাগে দিয়ে বীণা বাজালেন তখন খুবই সুন্দর সুর ছন্দ শুনা গেল। এর মধ্যে ভাবী বুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিলেন, মধ্যম পথ অবলম্বনই উত্তম। কৃচ্ছ সাধন ত্যাগ করে তিনি স্নান, আহার কৃত্য সম্পাদনের মধ্যদিয়ে মধ্যমপথ অবলম্বন করে তিনি সাধনমার্গে এগিয়ে গিয়ে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁকে অনুসরণকারী পঞ্চবর্গীয় শিষ্যগণ সিদ্ধার্থ ভ্রষ্ট হয়ে গেছেন এই মনে করে সিদ্ধার্থকে ত্যাগ করে চলে গেলেন, সিদ্ধার্থ ৬ বৎসর কঠোর সাধনার পর ৩৫ বৎসর বয়সে তিনি সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করে সর্বদুঃখের অবসান করে সর্বজ্ঞতা অর্জন করে বুদ্ধ হিসাবে খ্যাত হলেন।
মানবতাবাদের প্রবর্তক বুদ্ধ এশিয়াতে জন্ম গ্রহণ, বুদ্ধত্ব লাভ, ৪৫ বৎসর সদ্ধর্ম দেশনার পর ৮০ বৎসর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন, সবই এশিয়াতে, কিন্তু! আজ সমগ্র বিশ^ ব্রহ্মান্ডে বুদ্ধের সদ্ধর্মের অনুসারী দিন দিন বেড়ে চলছে। বিশ^বাসী বুদ্ধের জীবন দর্শন আলোচনা গবেষণা করছে, বুদ্ধের মৌলিক দর্শন চর্চা করছে। বিশ^বাসীর ধন-সম্পদের অভাব নেই, তারা এখন চায় পারিবারিক সুখ-শান্তি। এই অস্থিরতা থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র বুদ্ধের সাধনা পদ্ধতি চর্চার কোন বিকল্প নাই। বুদ্ধই একমাত্র মহামানব অস্থির মানুষকে স্থির করেছেন, অশান্ত মানুষকে শান্ত করেছেন। যার কারণে বিশ^বাসীর হৃদয়ে বুদ্ধের স্থান অত্যন্ত শ্রদ্ধার। বুদ্ধের জন্মের কারণে পৃথিবীর সর্বত্র ভারতবাসী বললে সকলে সম্মান করেন। “বৈশাখী পূর্ণিমা, বুদ্ধপূর্ণিমা বা বুদ্ধজয়ন্তী” আজ শুধু মাত্র বড়ুয়া বা বৌদ্ধদের নিকট সীমাবদ্ধ নয়। ইউনেষ্কো কর্তৃক “বেসাক ডে” কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশ ব্যতিত বিশে^র নানা দেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বুদ্ধ জয়ন্তী পালন করা হচ্ছে। আমরা যারা জন্মগত ভাবে বুদ্ধকে, বুদ্ধের সদ্ধর্মকে পেয়েছি আমাদের নিকট এখন কোন রকমে উদ্যাপিত হয়, আর যারা বুদ্ধের আদর্শকে জেনে শুনে গ্রহণ করেছেন তাঁদের নিকট বুদ্ধের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা আকাশ চুম্বি।
এক সময় আমাদের এঅঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে, লক্ষ্মী পূজা, স্বরশতী পূজা, শনিপূজা, মনসা পূজা, কার্তিক বরের ভাত এসব পূজা পার্বণের রমরমা অবস্থা ছিল। সমাজ-সদ্ধর্মের কল্যাণমিত্র মহান ভিক্ষুসংঘ বৌদ্ধ প্রধান দেশ সমূহে গিয়ে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ভিক্ষুসংঘের নিকট অতিব শ্রদ্ধা ও যত্নসহকারে ত্রিপিটক অধ্যয়ন করে জানতে পারেন আমাদের সমাজে যা চলছে তা সদ্ধর্ম সম্মত নয়, শাস্ত্র শিক্ষা শেষ করে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে বুদ্ধ পূজা, সীবলী পূজা, ফারিক (পরিত্রাণ) এসব চালু করলেন, সমাজের জ্ঞানী-গুণী দায়ক-দায়িকারা ও অনেক চেষ্টা প্রচেষ্টার দ্বারা ভন্তেদের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনেকটা সমর্থ হয়েছেন। এখন সমাজের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বুদ্ধ পূজার বাজেটের চেয়ে সীবলী পূজা ও উপগুপ্তের পূজার বাজেট অনেক বেশী। গুরু পূজার চেয়ে শিষ্যের পূজা বেশী সমাদৃত হচ্ছে, এটা কোন অবস্থাতে শুভ লক্ষণ নয়! আমরা এখন ভক্তি দিয়ে মুক্তি আশা করছি। বুদ্ধ বলেছেন, “ভক্তি দিয়ে মুক্তি হবে না, আর মূর্তি পূজা করেও মুক্তি হবে না।” মুক্তি কারো হাতে নয়, মুক্তি হবে আপন সাধনার দ্বারা। যে যত বেশী পরিশ্রমী হবে ততই তার সফলতা আসবে, যে যত বেশী অধ্যয়ন করবে, তার ফলাফল তত বেশী আশানুরূপ ফল লাভ করতে সক্ষম হবে। যিনি যত বেশী শীল-সমাধি-প্রজ্ঞায় উন্নত হবে তিনি ততই বেশী শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম ্এবং সাধনার দ্ধারা লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। অধ্যয়ন, অনুশীলন ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা সর্বোচ্চ উন্নতির শিখরে পৌঁছা অসম্ভব নয়।
বুদ্ধ পরিনির্বাণের সময় একক কারো হাতে সংঘ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পন করেননি। তিনি বলে ছিলেন, মহান সংঘই হবে এই সদ্ধর্মের উত্তরাধিকারী। প্রতি বৎসর বুদ্ধ পূর্ণিমা আসে, বুদ্ধ পূর্ণিমা যায়, প্রত্যেক বিহারে গতানুগতিক ভাবে বুদ্ধ পূর্ণিমা সম্পন্ন হয়। বুদ্ধ যে সংঘের উপর ভরসা করেছিলেন তার মধ্যে আমার মত নরাধম সংঘ সদস্য ছিল কিনা জানি না! আজ বাংলাদেশে বুদ্ধ জয়ন্তীর বাজেট বড় বেশী হলে ৫ লক্ষ ৭ লক্ষ আর বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর ২৫৬৩ বৎসরের শিষ্যদের জয়ন্তীর বাজেট ২০/২৫/৩০/৪০/৫০ লক্ষ টাকা। বিশাল বিশাল জয়ন্তী নায়কের চেয়ারসহ কিছুতে যেন ঘাটতি না হয়। সুধীজন কার জয়ন্তীর বাজেট বড় হওয়ার কথা ছিল আর হচ্ছে কি? আমরা করছি কি? বুদ্ধ জয়ন্তী কোন রকমে, ভন্তে জয়ন্তী এত বিশাল করে আয়োজন করা হয়, এর মধ্যে কাকে সম্মান বেশী করা হল, আর কাকে ম্লান করা হল। আমি ভন্তে আপনাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি, বুদ্ধের প্রতি আমরা যেন গভীর শ্রদ্ধা সম্পন্ন হই। প্রতি নিয়ত বলছি আপনারা লোভ-দ্বেষ-মোহ ত্যাগ করুণ, আমি ভন্তে এসব থেকে মুক্ত হতে পেরেছি কি? জানি আমার লেখা অনেকের পছন্দ হবে না। কারণ আমরা এখন স্রোতে গা-ভাসিয়ে দিয়েছি। কারপূজা, কার অনুশীলন বেশী হওয়ার প্রয়োজন ছিল, এখন হচ্ছে কার? কার জয়ন্তী অতিব প্রাণবন্ত হওয়ার দরকার ছিল! এখন কার জয়ন্তী বিশাল হচ্ছে। অথচ আমরা সকলে বুদ্ধের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকি, হে তথাগত অধম যোগ্য উত্তরসুরী হতে পারিনি, মৈত্রীর পতাকা তলে আশ্রয় দিয়ে অধমকে ক্ষমা কর। সকলের প্রতি শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছ।
“সকলে বুদ্ধ জ্ঞানে জ্ঞানী হোক।”