বুদ্ধমূর্র্তির উৎপত্তি ও ইতিকথা

মা তোমার মৃত্যু নেই
September 25, 2021
Monks
বুদ্ধ জয়ন্তী ও ভন্তে জয়ন্তী প্রসঙ্গে
September 25, 2021

বুদ্ধমূর্র্তির উৎপত্তি ও ইতিকথা

Buddha

Buddha

ধরিত্রিতে যখন মানবতা বিপন্ন হয়, মনুষ্যত্ব ভূলে যখন মানুষ পশুত্বে পরিণত হয়, ধর্ম ভূলে অধর্ম করে, সত্যকে ভূলে মিথ্যাচারে পরিণত হয়, পশু রক্তে যখন ধরাধাম প্লাবিত হয় তখনই মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম (ভাবী বুদ্ধ) খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। শাক্য রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হওয়ার পরও তিনি সমস্ত ভোগ বিলাসকে বিসর্জন দিয়ে ত্যাগমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাজ পরিবার ত্যাগ করে ছয় বছর কঠোর সাধনার ফলে সমস্ত তৃষ্ণার অবসানের পর তিনি সর্বজ্ঞতা অর্জন করে তিনি সম্যক সম্বুদ্ধ নামে খ্যাত হন। বুদ্ধের সময়ে কোন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল না। কোশল রাজ প্রসেনজিৎ বুদ্ধকে প্রশ্ন করেছিলেন, তথাগত আপনার অবর্তমানে কাকে পূজা করলে আপনার পূজা হবে? বুদ্ধ জবাবে বলে ছিলেন, আমার অবর্তমানে বোধিবৃক্ষকে পূজা করলে আমার পূজা হবে। এই প্রশ্নের কারণ হলো, বুদ্ধ তাঁর মূর্তি নির্মাণের সম্মতি প্রদান করেননি, এমনকি তাঁর মহাপরিনির্বাণের পাঁচশত বছর ব্যাপী সময়ের মধ্যে বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়নি।
এই দীর্ঘ ৫০০ বছর বিভিন্ন প্রতীকের মধ্যে বুদ্ধের অস্তিত্বকে বোঝানো হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:—-
১। হাতি:- বুদ্ধাংকুরের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণের প্রতীক।
২। পদ্ম:- বুদ্ধাংকুরের জন্মের প্রতীক।
৩। অশ^:- বুদ্ধাংকুরের গৃহত্যাগের প্রতীক।
৪। বোধিবৃক্ষ:- বুদ্ধাংকুরের বুদ্ধত্ব লাভের প্রতীক।
৫। ধর্মচক্র:- মহামানব বুদ্ধ প্রথম ধর্মপ্রচারের প্রতীক।
৬। স্তুপ (চৈত্য):- মহামানব বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রতীক।
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনুসারীগণ তাঁর প্রকৃত শিক্ষায় অবিচল শ্রদ্ধাসম্পন্ন ছিলেন। শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার সাধনায় দুঃখ মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিল্পকলা, চিত্রশিল্পী ও ভাষ্কর্যশিল্পীরা রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ শুরু হয়।
বুদ্ধ মূর্তির উদ্ভবঃ
মহামানব বুদ্ধের মহাপরিনিবার্ণকাল হতে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন কাল পর্যন্ত সময়ে (খ্রিঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতক হতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক) প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলায় কোন বুদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়নি। ভগবান বুদ্ধের ধর্ম মূলতঃ পারমার্থিক। এতে ব্যক্তি বা ভক্তিবাদের চেয়ে আধ্যাত্মিকতার বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্ভবতঃ মহাযান ধর্মমত ব্যাপক বিকাশের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বুদ্ধমূর্তির নিদর্শন বৌদ্ধ শিল্প কলায় সৃষ্টি হয়নি। কখন থেকে বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ শুরু হয়েছে বা প্রথম বুদ্ধ মূর্তি কোনটি এই নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিংবদন্তি অনুসারে গৌতম বুদ্ধ তিনমাসের জন্য তাবতিংসে তাঁর মা ও ঋদ্ধিমান দেবতাদের অভিধর্ম দেশনা করতে গিয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন রাজা কোশলরাজ প্রসেনজিৎ চন্দন কাঠের একটি বুদ্ধমূর্তি তৈরী করে। তাতেই তিনি বুদ্ধের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। এটি কতটুকু সত্য তা বিচার সাপেক্ষ। বুদ্ধের সময়ে অজাতশত্রু প্রমুখ বহু রাজন্যবর্গ ও শ্রেণীবর্গ বুদ্ধের একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন। তখন যদি বুদ্ধ মূর্তির প্রচলন থাকতো অবশ্যই তাঁরা বুদ্ধমূর্তি তৈরী করতেন। এর পর সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধধর্মের নিবেদিত প্রাণ। তিনি সদ্ধর্ম প্রচার ও স্থায়িত্বের জন্য শত শত স্তুপ, স্তম্ভ, বিহার, চৈত্য, রেলিং, শিলালিপি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তখনও বুদ্ধ মূর্তি প্রচলন কিংবা উদ্ভব হয়নি বলেই মৌর্য শিল্প কলায় বুদ্ধ মূর্তি দেখা যায় না। মহামতি সম্রাট অশোক যেরূপ সদ্ধর্মপ্রাণ নরপতি ছিলেন অবশ্যই তিনি বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ করাতেন। পরবর্তী শুঙ্গ-কান যুগেও বুদ্ধ মূর্তির নির্দশন দেখা যায়নি। এই যুগ পর্যন্ত বৌদ্ধ শিল্পকলায় বুদ্ধ মূর্তির প্রতীক হিসেবে ধর্মচক্র, উষ্ণীশ, বোধিবৃক্ষ, ভিক্ষাপাত্র, স্তুপ ইত্যাদি ব্যবহার করা হত। এ ধরণের রীতিকে শিল্পে ঝুসনডষরংস বলে। শুঙ্গ যুগের পর বৌদ্ধ শিল্পকলায় ঝুসনডষরংস এর ব্যবহার দেখা যায়।
কুষাণ যুগ ও গান্ধার শিল্পঃ
কুষাণ যুগে (খ্রিষ্টীয় ৫০ হতে ৩০০ বৎসর) গান্ধার শিল্পকলার সূচনা হয়। কুষাণ রাজা কর্তৃক বিদেশী শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাদের পক্ষাবলম্বনের কথাই ছিল কনিষ্ক ও তার অনুগামী কুষাণ রাজাদের সরকারী শিল্পকলা। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী হতে আরম্ভ করে তিন/চার শত বছরের শিল্পের অগ্রগতি এখান থেকে আরম্ভ হয়। এ জন্য ভারত শিল্পের ইতিহাসে এই যুগটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গান্ধার শিল্পের বিশেষ ধারাটি কুষাণদের দখলকৃত অঞ্চলেই প্রধানত বিকাশ লাভ করেছিল। দক্ষিণ অঞ্চলের কুষাণ রাজধানী মাট্টায় ভারতীয় শিল্পের একটা বিরোধ গড়ে উঠে। এ সময় কুষাণরা গান্ধার শিল্পীদের সমর্থন করে। তাই সহজে অনুমান করা যায় গান্ধার ভাস্কর্যের বেশীর ভাগ কর্মই বিদেশী শিল্প প্রভাব প্রত্যক্ষ ফল। যদিও গান্ধার শিল্পে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য লাভ করেছিল। তবুও তারা অনেক ভাস্কর্যের উপাদান সমূহ পশ্চিম এশিয়া বা গ্রীক সংস্কৃতি জাত বলে দেখতে পাওয়া যায়। সিন্দু নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন পেশোয়ার উপত্যকা সোয়াত ও বুনের ইত্যাদি অঞ্চল সমূহের প্রাচীন ভৌগোলিক নাম গান্ধার গ্রীক বীর আলেকজান্ডার চতুর্থ শতাব্দীতে গান্ধার জয় করেন। এর ফলশ্রুতিতে এখানে উপনিবেশ গড়ে উঠে। মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার-প্রসার লাভ অবশেষে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কুষাণরা শক (সিথিয়ান) পহলব (পাথিসিয়ান) ও গ্রীক রাজাদের পরাজিত করে গান্ধার অধিকার করেন। এ সময় গ্রীক ও ভারতীয় বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিশ্রনের ফলে এই অঞ্চলে যেই শিল্পকলা গড়ে উঠে তাকে গ্রীক বা গান্ধার শিল্পকলা বলা হয়।
কুষাণ যুগে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম মতের ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে। মহাযানীরা বুদ্ধের ধর্ম বাণীর চেয়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাই এদেরকে বলা হয় বুদ্ধযান বা বোধিসত্বযান। ফলে মহাযান মতের প্রকৃষ্ঠ বিকাশের ও গান্ধার ভাস্কর্যে উৎপত্তিতে সর্ব প্রথম নির্মিত হয় বুদ্ধ ও বোধিসত্বের মূর্তি গুলো। গান্ধার ভাস্কর্যের সৃষ্টি হল গ্রীক রোমান ও পারসিক ভাস্কর্যের সৃষ্টি হল গ্রীক রোমান ও পারসিক ভাস্কর্যের সঙ্গে ভারতীয় ভাস্কর্যের সংমিশ্রনে। অনেকের মতে হারকিউলিস, এ্যাপোলো, জিউজ ইত্যাদি গ্রীক দেব-দেবীর মূর্তির অনুকরণে গান্ধারের শিল্পীগণ বুদ্ধমর্তি নির্মাণ করেছিলেন। গান্ধার শিল্পীগণ প্রায়ই গ্রীক ও রোমান ছিলেন তাই তারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক পুরুষ শ্রেষ্ঠ বুদ্ধের ৩২ লক্ষণ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন। ফলে এখানকার উপাদান ভারতীয় হলেও নির্মাণ কৌশলের দিক দিয়ে এগুলো গ্রীক প্রভাবান্বিত। তাই তারা বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে কখনো দাঁড়ি বা গোফ ও আরোপ করেছেন। এই সময়কার বুদ্ধের এই মূর্তিগুলো ছিল বিদেশী ভাস্কর্যের “লেটএন্টিক” পদ্ধতিতে সৃষ্টি এক জঠিল পট শিল্প।
বুদ্ধমূর্তির ক্রমবিকাশঃ
কুষাণ যুগকে ভারত শিল্পের স্বুর্ণ যুগ বলা হয়। এই শিল্প বিকাশের ক্ষেত্র তিনটি। এদের মধ্যে অতি পুরাতন ও বিখ্যাত নগর মথুরা। এখানকার শিল্পকলায় বিদেশী ভাবধারা দেখা গেলেও শিল্প প্রেরণার মূল উৎসটি ছিল ভারতীয়। ভারতীয় শিল্পরীতিতে যে সমস্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নির্মিত হয় এগুলো হল মথুরা শিল্পের উদ্ভব। মথুরা শিল্পকলার প্রসার ঘটে তক্ষশীলা, সাঁচী, কোশাম্বী, শ্রাবস্তী, সারনাথসহ অন্যান্য স্থানে। মথুরা শিল্পকলায় বুদ্ধ ও বোধিসত্বের মূর্তিগুলো আত্মবিকাশ লাভ করে। কিংবদন্তি আছে যে, প্রথমে ভারতীয় শিল্পীরা বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের ব্যাপারে সাহস করেনি। কারণ বুদ্ধের এত মহাপুরুষ লক্ষণযুক্ত মূর্তি নির্মাণ করলেও তাদের এই মূর্তিতে বুদ্ধের মহাপুরুষ লক্ষণ গুলো ফুটিয়ে তোলা ভারতীয় শিল্পীদের মনপুতঃ হয়নি। তাই মথুরার শিল্পীরা এগিয়ে এলেন বুদ্ধমূর্তি নির্মাণে। মথুরার শিল্পীরা তাঁর ভাব ও আদর্শের রূপ দিয়েছেন বুদ্ধমূর্তিতে। এখানে সাধারণ মানব মূর্তির মতো বুদ্ধ মূর্তিতে রূপদান করা হয়নি। বুদ্ধমূর্তিকে অন্যমূর্তি হতে তফাৎ করা হয়েছে লক্ষণাক্রান্ত করে। তাই আজানুলম্বিত বাহু, মস্তকোপরি উষ্ণীর্য, কপালেউর্না, হাতের অঙ্গুলী জোড়া, প্রশস্তবক্ষ, সুক্ষ ত্রিচীবর ও মস্তকের পশ্চাতে প্রভামন্ডল সৃষ্টি করে মথুরা শিল্পকলায় বুদ্ধমূর্তিকে রূপদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মথুরা থেকে পাওয়া সিংহাসনে বসা বুদ্ধ মূর্তিতে ভাস্কর্য শিল্পের এক অদ্ভুদ অগ্রগতি দেখা যায়। এই মূর্তিই হল পরবর্তীকালের বসা মুর্তিগুলোর আদর্শ স্বরূপ, শিল্পী এখানে বুদ্ধের মুখশ্রীতে একটি সমার্জিত ভাব ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। মথুরার শিল্পীরীতি ভারতীয় ভাবধারায় নির্মিত বলে ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মথুরার বুদ্ধমূর্তি সমগ্র উত্তর ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মথুরা বৌদ্ধ শিল্পকলার প্রাণ কেন্দ্র হয়ে উঠে। বুদ্ধমূর্তি গুলোকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা : ১) স্থানক, ২)। আসন, ৩) শায়িত। এসব মূর্তির দ্বারা বুদ্ধের জীবনে বহুমূর্তি, যেমন- অভয়মুদ্রা, ভূমিস্পর্শমুদ্রা, ধর্মচক্রমুদ্রা ও মহাপরিনির্বাণমুদ্রা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।
ইক্ষাকুবংশ ও অমরাবতী শিল্পঃ
আনুমানিক খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে ইক্ষাকুবংশের রাজা শ্রী ধীর পুরুষদত্তের রাজত্বকালে তাঁর পৃষ্ঠ পোষকতায় অমরাবতীর বৌদ্ধ শিল্পকলা গড়ে ওঠে। এই শিল্পকলায়ও গান্ধার ও মথুরা শিল্পকলার সমন্বয় ঘটে। এখানকার শিল্প (বুদ্ধমূর্তি) সজীব ও প্রাণবন্ত। এখানে বহু বুদ্ধমূর্তির, বোধিসত্বমূর্তি নির্মিত হয়। কালে এই শিল্প ভারত সীমা অতিক্রম করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
গুপ্তযুগঃ
গুপ্তযুগেও (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতকে) বৌদ্ধ শিল্পকলার ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। যদিও বা গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল প্রতিপত্তি ছিল, কিন্তু গুপ্ত সম্রাটগণের পরম সহিষ্ণুতার জন্য তাঁদের সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারণ বিন্দুমাত্র ব্যাহত হয়নি। গুপ্তযুগে অন্যতম সংস্কৃতিক ও বানিজ্যিক কেন্দ্র ছিল পুন্ড্রবর্ধন এ সময় বুদ্ধমূর্তি গুলো অধিকতর সুন্দর, প্রাণবন্ত ও অনুপম সৌন্দর্য মন্ডিত। বুদ্ধমূর্তি গুলোতে মুখমন্ডলের সমানুপাত গঠন, করুণা বিলাসিত চক্ষুদ্বয়, ওষ্ঠের হাস্য লাবন্য-স্বর্গীয় পবিত্রতার পূর্ণবিকাশ দেখা যায়।
পালযুগঃ
পাল যুগেও বহু বুদ্ধমূর্তি ও বৌদ্ধদের দেব-দেবীর মূর্তি নির্মিত হয়। অষ্ঠম শতাব্দীর মধ্যভাগে “মাৎস্যন্যায়” বা অত্যাচার হতে মুক্তি লাভের জন্য বাংলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজা নির্বাচিত করেন। গোপাল ক্ষমতা লাভের ফলে এ সংকটময় অবস্থার অবসান ঘটে। গোপালের প্রতিষ্ঠিত বংশই পালবংশ নামে পরিচিত। এ পাল বংশই এদেশে খ্রিষ্টীয় অষ্টমশতক হতে বারশ শতক পর্যন্ত রাজত্ব করেন। পাল রাজারা সবাই বৌদ্ধ ছিলেন। রাজা ধর্মপালের সময়ে বিখ্যাত বিক্রমশীলা বৌদ্ধ বিহার, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার, কুমিল্লা জেলার ময়নামতি ও পন্ডিত বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্নতাত্বিক খননকার্যের ফলে এখানে বহু প্রত্ন সম্পদ আবিস্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেকের মতে, গুপ্ত যুগের তুলনায় পালযুগের মূর্তি শিল্প সংখ্যাও বিভিন্নতার ক্ষেত্রে অধিকতর লোকপ্রিয়তা অর্জন করলেও উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। শুধু পাল যুগের নালন্দার বিশেষ করে কালো পাথরের মূর্তিগুলো অধিকাংশ অভিনব সৃষ্টি। এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় বিভিন্ন নব কল্পনার অভিব্যক্তি ও সম্পূর্ন পরিণত সৃজনি শক্তির পরিচয়। এ সময়ে কাঁচের গড়া মূর্তিগুলো ও পালযুগের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, এগুলোর অনুকরণে কাশ্মীর, তাঞ্জের, নাগপট্টম, বার্মা, থাইল্যান্ড, জাবা ও শ্রীলংকায় প্রাপ্ত ধাতুমূর্তি গুলোতে মূর্তি শিল্পের দ্রুত ক্রমোন্নতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে প্রথম বুদ্ধমূর্তি পূজার কোন বিধান ছিল না। কারণ থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধের আধ্যাত্মিকতার বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মহাযান ধর্ম প্রকৃষ্ট বিকাশে বুদ্ধমূর্তির উদ্ভব বা পূজার প্রচলন হয়। কারণ মহাযানীরা বুদ্ধের ধর্মোপদেশের চেয়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। সুতরাং মহাযানে ভক্তিবাদের প্রকৃষ্ট প্রচারে বুদ্ধ মূর্তির উদ্ভব বা পূজার প্রচলন হয়।
সমগ্র বিশে^ হীনায়ানা বা থেরবাদী সম্প্রদায়ের বুদ্ধ মূর্তি গুলো প্রায় একই রকম। শুধু পার্থক্য আছে যে দেশের ভাষ্কর্য শিল্পীরা মূর্তি গুলো তৈরী করে মুখের অবয়বটা প্রায় সে দেশের মানুষের চেহারা ছবির সাথে অনেকটা মিলে যায়। ভাল করে দেখলে বুঝা যায় এটা কোন দেশের মানুষের দ্বারা তৈরী। বৌদ্ধ বির্দ্বেষী রাজন্যবর্গের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত ঐতিহাসিক প্রাচীন বিহার ও মহাবিহার খননকার্যের ফলে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যে সকল মূর্তির সন্ধান পেয়েছেন প্রায় মহাযান সম্প্রদায়ের ভাব-ধারায় নির্মিত মূর্তি। বর্তমান এদেশে যাদুঘর ব্যতিত মহায়ানা মূর্তি দেখা যায় না। থেরবাদী অনুসারী দেশ ব্যতিত মহায়ানা দেশ সমূহের অনুসারীদের ভাষ্কর্য শিল্পীরা তাঁদের মত করে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব এবং জাতক কাহিনী অনুসারে কত হাজার রকমের দেব-দেবী, পশু-পাখির মূর্তি সাড়া বিশে^ দেখা যায়।
নানা যুগে, নানা ভাষ্কর্য ও চিত্র শিল্পীদের দ্বারা তৈরী করা বুদ্ধ প্রতিবিম্ব পূজার বেদীর আসনে কালক্রমে স্থান পেয়েছে। এই মূর্তি তৈরীর পূর্বে বুদ্ধের অনুসারীগণ তখন মহামানব বুদ্ধ চারি অসংখ্য লক্ষ কল্প পারমী পূর্ণ করে কঠোর কঠিন সাধনার দ্বারা অর্জিত সত্যকে জানার জন্য শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলন করতো। আর বর্তমান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রায়জন মূর্তির সামনে পূজা অর্চনা করে নানা আরাধনায় রত হন। যার ভক্ত-অনুসারী বলে আমরা দাবী করি তাঁর সম্যক পথ শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার দ্বারা সমস্ত দুঃখের অবসান সম্ভব। ভক্তি দিয়ে মুক্তি হবে না, আর মূর্তি পূজা করেও মুক্তি হবে না।
শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, যিনি বুদ্ধ প্রতিবিম্ব দান করেন, বোধিবৃক্ষ রোপন করেন, ভিক্ষুত্ব বা উপসম্পদা গ্রহণ করেন তাঁরা ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। এটা শাস্ত্রের চিরন্তন সত্য বাণী। বুদ্ধ মূর্তি দান করার সাথে সাথে দাতাকে বোধি লাভের জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। বোধিবৃক্ষ রোপনের সাথে সাথে বোধি অর্জনের সাধনা করতে হবে। ভিক্ষুত্ব বা উপসম্পদা জীবন গ্রহণের সাথে সাথে কর্মস্থান নিয়ে শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার সাধনায় রত হবে । শাস্ত্রের অমোঘবাণী তখনই সত্য প্রমাণিত হবে। বর্তমান সমাজে অহরহ বুদ্ধ প্রতিবিম্ব দান করা হচ্ছে, বোধিবৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে, উপসম্পদাও গ্রহণ করা হচ্ছে! কিন্তু এসব মানুষের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন তম (অজ্ঞানতা) দূর করতে না পারলে সবই গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছু নয়। আমাদেরকে গুণী মানুষ, আলোকিত মানুষ হতে হবে।
আমার জানা মতে, বিশে^ যতগুলো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে তার মধ্যে আফগানিস্তানের বামিয়ামের বিশাল বুদ্ধমূর্তির উচ্চতা ছিল অবিশ^াস্য, প্রায় ১৮০ ফুট। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ইউয়ান চোয়াং এর বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, এই মূর্তি ছিল সোনালী আলোর ছটায় উজ্জ্বল যা দেখে মনে হতো এটি হয়তো স্বর্ণ ফলক দিয়ে মোড়া অথবা স্বর্ণচুর্ণ মিশ্রিত রংয়ের দ্বারা প্রলেপ দেয়া ছিল। বিশিষ্ট বৃটিশ পন্ডিত ওয়ারউইক বল– মন্তব্য করেছেন যে, এই মূর্তি বিশে^র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প কীর্তি গুলির মধ্যে অন্যতম। ইউয়ান চোয়াংয়ের বর্ণনায় পাওয়া যায় এ অঞ্চলে ১,০০০ ফুট লম্বা শায়িত বুদ্ধ মূর্তি ছিল যা বহু প্রচেষ্টা সত্বেও আবিষ্কৃত হয়নি।
বিগত কয়েক দশকের মধ্যে এদেশে ছোট বড় অনেক বুদ্ধ প্রতিবিম্ব নির্মিত হয়েছে এবং নানা দেশ থেকেও আনা হয়েছে। আমাদের এঅঞ্চলে মূর্তি গুলোকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা হয় ভক্তি ও আরাধ্য হিসেবে। উধারভাবে দেখার সুযোগও নাই আর যারা এ বিষয় নিয়ে চর্চ্চা করেন তাঁদেরও উধার পরামর্শ দৃশ্যমান নয়। অথচ বিশে^ যত ধর্মমতের নিদর্শন স্বরূপ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এসবের মধ্যে বুদ্ধমূর্তি বিশ^ময় জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়ে আসছে, শুধুমাত্র বৌদ্ধদের নিকট নয়, গুণী ও মুক্ত চিন্তার সকল মানুষের অন্তর জুড়ে আছে বুদ্ধ। সকল সম্প্রদায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের ত্যাগকে অনেক বড় করে দেখেন। তাঁর সাধনালব্ধ প্রজ্ঞাময় শান্তির বাণী আত্মদীপ হও, আত্মশরণ নাও, আত্ম দর্শন কর, এই জগৎ সংসারে তোমার দুঃখ মুক্তির দাতা কেউ নয়! সকল ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারক মুক্তির পথ প্রদর্শক মাত্র। তুমিই তোমার মুক্তি দাতা। স্বর্গ-নরক, জান্নাত-জাহান্নাম তোমার দ্বারা সৃষ্ট, তোমার কর্ম ও কর্মফল তোমার আগামী নির্ধারণ করবে।
আজকের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সুরম্য বুদ্ধ প্রতিবিম্ব প্রতিষ্ঠা একদিন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে থাকবে।
“সদ্ধর্ম চিরস্থিতি হউক”

যেসকল অননাইলের প্রতি কৃতজ্ঞ : * বিবর্তন অননাইন * নির্বাণা পিস্ অননাইন * উইকিপিডিয়া

Leave a Reply