মা তোমার মৃত্যু নেই

Buddha
বুদ্ধমূর্র্তির উৎপত্তি ও ইতিকথা
September 25, 2021

“মাতা-পিতু উপট্ঠানং, পুত্তদারস্স সঙ্গহো,
অনাকুলা চ কম্মন্তা, এতং মঙ্গল মুত্তমং।”

অনুবাদ: পিতা-মাতার সেবা, সদুপদেশাদির দ্বারা স্ত্রী-পুত্রের উপকার ও নিষ্পাপ কর্ম করিয়া জীবিকা নির্বাহ করাই উত্তম মঙ্গল।
আদিমকালে মানুষ এবং পশু-পাখিদের জীবন-যাপন তেমন কোন পার্থক্য ছিল না, পার্থক্য ছিল শুধু দৈহিকগড়ন ও গঠন। পশুপাখি যেমন প্রাকৃতিক ভাবে বাচ্চা জন্ম থেকে বেড়ে উঠা পর্যন্ত অফুরন্ত ভালবাসায় সন্তানকে লালন-পালন করে, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি হয়। মানব-সন্তান সহজেই মানুষ হয় না। পশু-পাখি মাতৃগর্ভ থেকে ধরাধামে আসার সাথে সাথে দাঁড়াতে চায়, দাঁড়াতে পারে, দৌড়াতে পারে, পরিপক্ষ সময়ে ডিম থেকে বাহির হওয়ার পর দাঁড়াতে পারে, দৌড়াতে পারে। কিন্তু! মানব সন্তান জন্মের পর মা, ধাত্রি, ধাইমা যদি সাহায্য না করে গর্ভাশয়ের রক্তে লুটোপুটি করে মল-মূত্রে একাকার হয়ে কান্না ছাড়া অন্যকোন উপায় তার থাকে না। পশু-পাখি জন্মের সাথে সাথে নিজের আহার খুঁজে নিতে তাও অনেকটা সক্ষম হয়। মানব সন্তান কত অসহায়, কেউ না কেউ সহযোগিতা না করলে মাতৃদুগ্ধ খুঁজে নিতে পারে না। এই মানব সন্তানরা যদি অভিভাবকহীন ভাবে গড়ে উঠত, কতযে হিংস্র রূপ ধারণ করতো তা ভাবাও যায় না। মানব সন্তান মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে মাতা-পিতা, প্রতিবেশী, শিক্ষক ও সর্বোপরি একটি সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। মানুষ হওয়ার পেছনে অনেকের সহযোগীতা স্মরণীয়, কিন্তু! সবার মধ্যে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানকে বেমালুম ভূলে বাবা দ্বিতীয় তৃতীয় চিন্তা করে, মা তার নাড়ী কাটা সাত রাজার ধন বুকে নিয়ে যে কোন মূল্যে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়। পাড়া-প্রতিবেশী কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে, কতজন নানা কথা বলে কলঙ্কিত করছে, মা অবোধ সন্তানের মুখের দিকে থাকিয়ে সবই সহ্য করছে তার সন্তান একদিন বড় হয়ে উঠবে এই ভরসায়। মা শুধু নাম বধনাম সহ্য করেন তাই নয়। নিজের আয়ু দিয়ে সন্তানের জীবন কামনা করেন। আমরা ধীন সন্তানেরা তার প্রতিদানে কতটুকু সুখ-শান্তি, সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি। যদিওবা মা প্রতিদানের আশায় কিছু করেন না। মা, বিহারে, মন্দিরে, মসজিদে ও গীর্জায় গিয়ে তাঁর একটি মাত্র আরাধনা আমার সন্তান ভাল থাকুক সুস্থ থাকুক। আর আমরা যরা অবোধ সন্তান, কতভাবে সেই মাকে শারীরিক নির্যাতন থেকে প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনে মাকে কষ্ট দিয়ে থাকি। মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে কেউ দেখলে, কেন কাঁদছেন এ কথা জিজ্ঞাসা করলেও মা বলে না, কারণ তার সন্তানকে সমাজ নিন্দা করবে এই ভয়ে। হায়রে মা, অভাগীনি মা তারপরও সন্তান কি পছন্দ করে তা তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মা সন্তানকে অন্তর থেকে কোন অভিশাপ দেন না, সর্বদা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন।
মহামানব বুদ্ধের গুণী শিষ্য শারি ব্রাহ্মণীর সন্তান ভদন্ত শারিপুত্র মায়ের পূর্বে পরিনির্বাণ লাভ করবেন এ কথা জেনে তিনি বুদ্ধের অনুমতি নিয়ে মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ণ মায়ের ধর্মচক্ষু উৎপন্ন করানোর জন্য ভদন্ত, শারিপুত্র পিতৃ পরিবারে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন, মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার অনন্য দৃষ্টান্ত।
ভাবী বুদ্ধাঙ্কুর জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে মা রাণী মহামায়ার প্রয়াণ হয়, কঠোর সাধনায় তিনি বুদ্ধ হওয়ার পর মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনার্থে, ৩মাস কাল তাবতিংস স্বর্গে পট্ঠান দেশনা করে মায়ের দুঃখ মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। দৃষ্টান্ত গুলো নব প্রজন্মকে প্রাণীত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে আশা করছি।
সন্তানের প্রতি মমতাময়ী মায়ের ভূমিকা আদি অনন্তকাল চলমান। মাতা-পিতার মৃত্যু সংবাদটি প্রত্যেকটি পুত্র-কন্যার নিকট অত্যন্ত দুঃখের এবং কষ্টের এতে কোন সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে শবদেহ নিয়ে ধর্মীয় কিছু আচার-আচরণ বিদ্ধমান। পাশাপাশি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সে আচার-আচরণ তাদের মত করে তারা সম্পন্ন করেন। বৌদ্ধদের অনিত্য সভা কেন জানি মূল জায়গা থেকে পথ হারাতে শুরু করেছে। অন্য কোন সম্প্রদায়ে শবদেহ সামনে নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা, শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শ্রদ্ধা নিবেদন, পুণ্যদানের পর পুণ্যদান দেখা যায় না। আরো কষ্টের যা, তা হচ্ছে শবদেহ সামনে রেখে চা-মিষ্টি ও ভিক্ষুদের নানা রকম পানীয় পরিবেশন করা এবং ব্যান্ডপার্টি ও বাজি দিয়ে অনিত্যসভা এক রকম উৎসব মুখর হয়ে উঠে। প্রয়াতের সন্তানেরা মৃত মাতা-পিতার পাশে না থেকে দেখা যায় আতিথেয়তায় ব্যস্ত ও কে বা কারা বক্তব্য দেবে এই তালিকা তৈরীতে অনেকটা ব্যস্ত। কল্যাণমিত্র সুধীজন, ধনী হোক গরীব হোক আপনার মাতা-পিতার অনিত্য সভায় কেউ আপনার আতিথ্যের প্রত্যাশায় যায়নি। মাননীয় ভিক্ষুসংঘ ও সমাজের মধ্যে যারা গ্রামীণ ভাবে সাংগঠনিকভাবে বা কেন্দ্রীয় ভাবে আপনারা যারা নেতৃত্বে আছেন এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
এমনও নির্মম ঘটনার কথা জানা আছে, অনেক কষ্টে যে সন্তানকে মানুষ করেছে সে সন্তান মাতা-পিতার কত যে চোখের জল জড়িয়েছে, মাতা-পিতার শেষ সময়ে সুখ-সাচ্ছন্দের জন্য নিজের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করেছে এবং করছে, সে সব নরাধম সন্তান ও বধূমা তারা মাতা-পিতা- শ্বশুর শ্বাশুরী মৃত্যুর পর রাজ্যের ভন্তেদের ফাং করে যা উল্লেখিত হয়েছে তার চেয়েও বেশী আয়োজন করে, সেবা যত্ন করেছি, কি করিনি দুনিয়ার লোক তো দেখেনি, অন্ততঃ আজকের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান সবাই দেখেছে এবং সভায় যারা এসেছে সবাইতো প্রশংসা করেছে! সে সব সন্তানদের ধিক্কার জানাই, যারা জন্মদাতা পিতা-মাতার সাথেও এরূপ প্রতারণার আশ্রয় নেয়। সে দিনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুণ যে ব্যবহার আপনি আপনার মাতা-পিতা, শ্বশুর শ্বাশুরীকে করেছেন, আপনার সন্তান আপনাকে আরো বেশী খারাপ ব্যবহার করবে। যতই সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান, বুদ্ধের সামনে গিয়ে আরাধনা, তীর্থে গিয়ে যতই ক্ষমা প্রার্থনা করুণ এই কর্মের কোন ক্ষমা নেই। যে বীজ রোপন করেছেন, সে বীজে অন্য বৃক্ষও হবে না অন্য ফলও দেবে না।
যারা বুদ্ধগয়া তীর্থ ভ্রমণে যেতেন বাংলাদেশীরা সে সময় প্রায় শতভাগ আন্তর্জাতিক বিদর্শন সাধনাকেন্দ্র একমাত্র ঠিকানা। উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ বরেণ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু পূজ্য ড. রাষ্ট্রপাল মহাথেরোকে তীর্থযাত্রীরা গিয়ে ভন্তেকে বলতেন, “ভন্তে, আমরা পিতা-মাতা, শশুর শাশুরী ও জ্ঞাতিদের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করব। ভন্তে, সবাইকে বলেছেন, আগামীকাল ১০টার সময় হলঘরে আসবেন, তীর্থযাত্রীরা যথাসময়ে হল ঘরে উপস্থিত হয়, ভন্তেও তাঁর বিহারস্থ ভিক্ষু-সংঘকে নিয়ে উপস্থিত হন, স্বভাব সুলভ ভাবে শীলাদি দেওয়ার পর সদ্ধর্ম দেশনা করার সময় তিনি বলেন, আপনারা অনেক দূর থেকে অনেক অর্থ ব্যয় করে পিন্ডদান করার জন্য বুদ্ধগয়া মহাতীর্থে এসেছেন, আপনারা জীবিত মাতা-পিতার সেবা-যত্ন করেছেন? উপস্থিত কেউ কেউ সরব আবার অনেকে নিরব, তখন তিনি বলতেন, যারা জীবিত মাতা-পিতার সেবা-যত্ন করেছেন তারা আসল পিন্ডদান করেছেন, আর যারা জীবিত মাতা-পিতাকে সেবা-যত্ন না করে তীর্থে এসে পিন্ডদান করছেন এটা নকল পিন্ডদান। এক সময় প্রায় মাতা-পিতার পরিবারে কয়েকটি ছেলে-মেয়ে বর্তমানে বড়ুয়া বৌদ্ধদের পরিবার একেবারে ছোট আঁকার নিয়েছে, কেউ না কেউ দেখার ছিল আপনার কষ্টের সময়, সেই সময় ও সুযোগ আর নেই। তখন আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে যাাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
মাতা-পিতা আমার পৃথিবী। আপনার ছেলে-মেয়েকে আপনি যেমন তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণই আপনার একমাত্র স্বপ্ন, সে স্বপ্ন আপনার মাতা-পিতারও ছিল। তারপরও কেন বৃদ্ধ মাতা-পিতার প্রতি অবহেলা অনাদর। এক সময় পিতা মারা গেলে মা বড়, মেঝ ও সেজ ছেলের নিকট পালা ভাগ করে করে খাওয়া-দাওয়া চলতো, মা-বাবা ৫/৭ জন সন্তানকে লালন-পালন করেছেন, কিন্তু! কোন কোন সন্তানেরা একটি মাকে ভীষণ বোঝা মনে করে। আরো বলতে শুনি মা আমার একার নাকি?
“মা” তোমার তুলনা তোমাতেই মিলে, সন্তানদের সবকিছু তুমি হজমও কর, সহ্যও কর। তোমার ঋণ এই অধম সন্তানের কোনদিন পরিশোধ করতে পারবে না, সম্ভব নয়! তাই বলি পরিবারের সকল সদস্যদের প্রতি আহ্বান, জানি আপনি বুদ্ধপূজা নিয়ে বিহারে যাবেন, বোধি বৃক্ষের গোড়ায় পানি ডালবেন ও তীর্থে গিয়ে অষ্টপরিষ্কার দান করবেন, তার আগে বৃদ্ধ মাতা-পিতা, শ্বশুর শ্বাশুরীকে একবার জিজ্ঞাসা করুণ, মা-বাবা তোমাদের কিছু লাগবে? বুদ্ধ আপনার পূজার জন্য অপেক্ষা করছে না, আপনার পরিবারের বয়োবৃদ্ধরা কিন্তু অপেক্ষা করছে। আপনি ঔষধ পথ্য দেবেন সে অপেক্ষায় আছে, আপনারা ব্যস্ত আছেন মনে করে কিছু বলছে না। মাটির মূর্তি আর পাথরের মূর্তি আপনার মুক্তি দাতা নয়, জঙ্গম তীর্থ (জীবন্ত তীর্থ) গৃহলক্ষ্মী মাতা-পিতাকে শ্রদ্ধা-সম্মান, সেবা-যত্ন করুণ তাঁদের আর্শীবাদ আপনাদের জীবনের পথ চলার পাথেয় হবে, সুখী হতে পারবেন। অনিতা বড়ুয়া মহোদয়া ভাল, গুণী ও ধার্মিক মা ছিলেন, সন্তানেরাও আলোকিত, মাতৃভক্তি পরায়ণ সন্তান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
“মা তোমার দুঃখ মুক্তি হোক।”