সমাজের প্রতি তরুণদের দায়বদ্ধতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

Monks
সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক ভাবনা
September 25, 2021
Buddhism
Buddhism and Ethnic Harmony — P. R. BARUA
September 25, 2021

সমাজের প্রতি তরুণদের দায়বদ্ধতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

monks in the front of sea

monks in the front of seaসভ্যতার আর্বিভাব থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র বিশে^ তরুণদের জয় জয়কার। বিশে^র যত বৈচিত্রপূর্ণ সৃষ্টি যত নান্দনিকতায় পূর্ণ সবকিছুর মধ্যে কারো সৃষ্টির পরামর্শ, কারো পৃষ্টপোষকতা এবং তরুণদের কঠোর কঠিন ঘাম ও শ্রম। প্রগতি সংঘের সদস্যদের শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীপূর্ণ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। প্রগতি সংঘের সৃষ্টি থেকে যারা হাল ধরেছিলেন তাঁদের অনেকের বয়স ৪০/৫০ ছুঁই ছুঁই। সবাই একই মোহনায় এগিয়ে এসে তাঁদের ছোট ভাইদের ও সন্তানদের আগামীর পথ চলার দিক নির্দেশনা দিয়ে উৎসাহিত করা আজ বড় বেশী প্রয়োজনানুভব করছি। এক সময় পরিবারের বাবা-মা, বড় ভাই ও দিদি যা শাসন অনুশাসন করেছে তা আমরা মাথা নীচু করে শুনেছি এবং প্রতিজ্ঞা করেছি ভবিষ্যৎ এরূপ ভূল করবো না। পাড়ার জেঠা-কাকা ও বড়রা শাসন-অনুশাসন করলে একমাত্র ঠাকুর মা ছাড়া বাড়ীর অন্যরা এব্যাপারে বেশী কোন কথা বলাবলি করতো না। আজকের দিনে বাবা-মা পরিবারের সদস্যরা ছোট শিশুটিকে শাসন-অনুশাসন করার সময় চিন্তা করতে হয় তার অনুভূতি বা সম্মানে কোন আঘাত লাগছে কি না! নিজের পরিবারের কথা বিবেচনা করে পাড়ার বা গ্রামের বড়রা কারো ছেলে মেয়ের অন্যায় দেখলেও বলার সাহস হারিয়ে ফেলছে, যার কারণে সমাজে দিন দিন তরুণরা দিক ভ্রান্ত হচ্ছে। এটা কোন অবস্থাতে শুভ লক্ষণ নয়। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান বোধকে কোন অবস্থাতে ম্লান করা যাবে না এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ-আদর, আদেশ-উপদেশ, শাসন-অনুশাসন না থাকলে আগামী প্রজন্ম পথ হারাবে! তাতে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হবে পরিবার তারপর সমাজ ও রাষ্ট্র।
কোন শিশু জন্মের পর থেকে অভিভাবক হীন যদি বড় হয়, মানুষ হওয়ার মতো পরিবেশ যদি না পায় সেই সন্তানের চেহারা ছবি কত ভয়ংকর হবে তা চিন্তারও অতীত। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজ বদ্ধ জীবন যাপনই মানুষের ধর্ম। কোন কোন মানুষ শহুরে জীবন যাপনের কারণে অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার কারণে বলতে শোনা যায় আমার সমাজ দরকার নাই, গ্রাম দরকার নাই, শত কষ্টের মধ্যেও ভূল করে একথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কুখ্যাত, নিন্দনীয় অপরাধী হলে সমাজে তার পরিচয়ের বেশী প্রয়োজন হয় না! মানুষ যতই গুণী হবে, খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হবে ও সাধারণ থেকে অসাধারণে পরিণত হবে তখন, সমাজ দেশ খুঁজতে শুরু করবে তাঁর চৌদ্দপুরুষের বসবাস কোথায় ছিল, তাঁর আজকের অবস্থানে আসার জন্য তাঁর অনুপ্রেরণা কি? মানুষ যতই বড় হয়, ততই আলোকিত মানুষেরা তাঁর শিখরের সন্ধান করে। তাই আজকের তারুণ্যের জয়গাণে সকলে মুখরিত হোক, সকলের মুখে উচ্চারিত হোক “আমি তোমাদেরই একজন।”
বাঙ্গালীরা বিশে^র যে কোন জায়গায় অবস্থান করুক না কেন পাঁচজন হলেই একটি সংগঠন গড়ে তোলে, এটা ভাল উদ্যোগ, কিন্তু শুরু সুন্দর শেষ সুন্দর হয় না। দলা-দলি, ভাগা-ভাগিতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। সাড়া জীবন পড়েছি একতাই বল, একতাই শক্তি। বৌদ্ধদের সাংগঠনিক অবস্থাটা আরো নাজুক! গ্রাম বা বিহারের বাইরে গিয়ে আপন যোগ্যতাবলে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কোন নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি, আমরা আছি শুধু গ্রাম্য দলাদলি আর বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি/সম্পাদক হওয়ার জন্য গ্রামের মধ্যে নানা ভাগে বিভক্তি। তাতে আমার যোগ্যতা হচ্ছে, আমি এই গ্রামের মানুষ ও এই বিহারের দায়ক এবং আপনি যেমন পিন্ডদান (ছোয়াইং) ও দান-দক্ষিণা দেন, আমিও দিয়ে থাকি, আপনার চেয়ে আমি কম কোথায়? আপনি হতে পারলে, আমি হতে পারবো না কেন? এই বাদ-বিসংবাদ নিয়ে কত গ্রাম বিভক্তি হয়ে আছে, কত বিহার দলাদলির কারণে অর্থ-বিত্ত থাকার পরও উন্নয়নের বিরাট বাধা হয়ে আছে। বুদ্ধ আজ থেকে ২৫৬৩ বৎসর আগে আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছেন, আজ আমরা করছি কি? আমরা আমাদের অহং-অহমিকা, আমিত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। বিহার পরিচালনা কমিটি! বিহার দায়ক-দায়িকার প্রয়োজন সেবা, শ্রদ্ধা, বন্দনা, ধ্যান-জ্ঞান প্রজ্ঞার চর্চ্চার মাধ্যমে দুঃখ মুক্তির পথ অন্বেষণ করা, বিহারে গিয়ে বিহার পরিচালনা কমিটির সদস্যগণ কাকে পরিচালনা করবেন? বুদ্ধকে? ভন্তেকে? শ্রামণকে? বিহার পরিচালনা কমিটি না হয়ে “বিহার সেবা কমিটি” হলে আমার পদ-পদবি নিয়ে যে অহংকার তা অনেকটা হ্রাস পাবে বলে আমি মনে করি। থাইল্যান্ড, মায়ানমার ও শ্রীলংকা এসকল দেশে যে বা যারা বিহার সেবার কাজে নিয়োজিত উনারা সদ্ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, ধর্ম-বিনয় সম্পর্কেও তাঁদের জ্ঞান আছে এবং ধনও আছে, মনও আছে। দানে-অনুদানে সকলের অংশ গ্রহণ থাকে বাকি প্রয়োজন যা সবই সেবকেরা নিজেরা দান করে যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে সম্পন্ন করেন। ভন্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন ভন্তের সেবকেরা। দেখেছি সেবকেরা ত্রুটি মুক্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার কাজ করছে , পঞ্চশীল-অষ্টশীল প্রার্থনা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন ফুল প্রদান ছাড়া কোন দায়ক-দায়িকা মঞ্চ বা মাইকের আশে পাশে নেই! আমাদের সভা-সমিতি গুলো তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বক্তব্য মঞ্চের আশে পাশে অনেক জন দাঁড়িয়ে থাকে, বসে থাকে, উদ্বোধনী ভাষণ, স্বাগত ভাষণ, শুভেচ্ছা বক্তব্য, উদ্বোধনী সংগীত, ফুল দেওয়া, ক্রেষ্ট দেওয়া, উপস্থাপনা এনিয়ে সমাজের মধ্যে গ্রামের মধ্যে কলহ বিবাদ ও দলাদলির কোন শেষ নেই, সমগ্র সমাজের একই চিত্র। বড়ুয়া সমাজে একই গ্রামে একই পাড়ায় অসংখ্য বিহার ও সংগঠনের জন্ম হয়েছে একমাত্র কারণ আপনার নাম আছে! আমার নাম নেই কেন? আপনাদের গোষ্টির বিহারে আমরা যাবো না, সমাজে যত গুলো সর্বজনীন বিহার সৃষ্টি হয়েছে প্রায় বিহার ঝগড়া-বিবাদ ও মানসিক দূরত্বের কারণে। আপনার আমার পূর্ব পুরুষেরা এক সময় শ্রদ্ধার সাথে কবলা মূলে দানপত্র করে পুণ্যানুষ্ঠান করে জল ঢেলে আগত-অনাগত ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশ্যে দান করে দিয়েছেন সেখানে বিহারে আমি, আমার ও আমাদের থাকার কথা নয়! কয়েক যুগ পার হয়ে শত বৎসর পরও দাতার বংশের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এই দানকে আমার আমাদের বলে দাবী করেন! দানপত্র কবলা মূলে এবং জল ঢেলে উৎসর্গ করার পর আমার আমাদের বলে দাবী করা কতটা ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিযুক্ত ও ধর্মসম্মত। এর দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করছি! না, আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা সম্মানকে অপমান করে দানকৃত একটি পবিত্র বিহার ভূমিকে আমার বলে দাবী করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত, যৌক্তিক, ধর্মবিরোধী কাজে নিয়োজিত হয়ে মহাপাপ কর্মে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এদেশে আমরা একেবারে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, দলাদলি, ভাগাভাগিতে আরো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছি। আপনার আমার কষ্ট রাখার জায়গা আছে? কোন কোন গ্রামে আমাদের ভোটার সংখ্যা বেশী হওয়ার পরও অন্য সম্প্রদায়ের লোক আমাদের ভোটে নির্বাচিত হয়, আমাদের স্ব-সম্প্রদায়ের মানুষটিকে আমরা নির্বাচিত করতে পারি না! এ লজ্জ্যা কোথায় রাখবেন? বর্তমান তরুণ সমাজের নিকট আমার আকুল আবেদন আপনার পরিবার, সমাজ-সদ্ধর্ম ও দেশ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবার, সমাজ সম্প্রদায়ের ও রাষ্ট্রের সম্মান রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। মা-বোনের ইজ্জ্বত সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব তরুণ সমাজের। জানি না আমার লেখাটা ছাপানো হবে কি না, আর কোন দিন লিখতে বলবে কি না? তার পরও সমাজের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা থেকে কিছু সত্য কথা অবশ্যই লিখতে হবে। আমাদের সমাজের প্রায় সংগঠন ও ক্লাব অনেকটা বিহার ভিত্তিক। বিহারে সারাদিন কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে দান-শীল-ভাবনা, শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা ও সমাজের উন্নয়ন-উন্নতি নিয়ে দেশনা হয়, আলোচনা হয়, আবার সন্ধ্যার সময় একই আঙ্গিনায় সাংস্কৃতিক বা সংগীত সন্ধ্যার নামে সাড়া দিনের ধর্ম-কর্মকে বেমালুম ভূলে নাচানাচি শুরু হয়। বাবুরা আমি সংগীত বা সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের বিপক্ষের মানুষ নই, সুস্থ-সুন্দর নান্দনিক সৃষ্টিশীল সংস্কৃতিকে সম্মান করি। এর মধ্যে বরেণ্য সংগীত শিল্পী আয়ুব বাচ্চু, সুবীর নন্দী প্রমূখ তাঁদের জন্য অনন্ত ভালবাসা। আমার কথা হচ্ছে যেটা যেখানে মানায়। আজকাল বেশীর ভাগ ভন্তেরাও সঠিক কথা, সত্য কথা বলে কারো বিরাগ ভাজন হতে চান না! অনেকটা এমন হয়ে গেছে, যায় যদি দিন যাক না। মাথায় যদি পচন ধরে এই সমাজ ও সদ্ধর্ম শেষ রক্ষা সম্ভব হবে না। আমি যেখানে অবস্থান করি না কেন একটি কথা বলি, “আমি দানও ভালবাসি গানও ভালবাসি” কোনটাতে আমার অরুচি নাই, তবে কথা হচ্ছে হয়ত দান হবে, না হয় গান হবে। যে কোন একটাই হবে।
প্রগতি সংঘের সদস্যবৃন্দ, আগামী প্রজন্ম আমাদের ভবিষ্যৎ বির্নিমাণে কাজ করবে আমরা তাঁদের হাতে কি তুলে দিচ্ছি অবশ্যই ভাবতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা চাই। শিশুদের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার সাথে সাথে নৈতিক চরিত্র গঠনে বিহার ভিক্তিক ধর্মীয় শিক্ষা একান্ত আবশ্যক, বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, খেলা-ধুলায় অংশ গ্রহণ করা। গুণী আলোকিত সন্তান সৃষ্টি করতে না পারলে প্রগতি সংঘের প্রগতি স্থবির হয়ে যাবে। আজকের প্রগতি সংঘের পদক্ষেপ হোক আগামী দিনের প্রজন্মকে আলোকিত মানুষ করার দৃঢ় প্রত্যয়। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক প্রগতি সংঘ।
“তারুণ্যের জয় হোক।”

Leave a Reply