সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক ভাবনা

Monks
বুদ্ধ জয়ন্তী ও ভন্তে জয়ন্তী প্রসঙ্গে
September 25, 2021
monks in the front of sea
সমাজের প্রতি তরুণদের দায়বদ্ধতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
September 25, 2021

সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক ভাবনা

Monks

Monks

মহামানব বুদ্ধের সময় তাঁর সদ্ধর্ম দেশনার মধ্যদিয়ে রাজ পরিবার থেকে শুরু করে শ্রেষ্ঠী পরিবার এবং কৌরকার পুত্র অনেকে তাঁর অনুসারী হয়ে কর্মস্থান গ্রহণ করে বুদ্ধের সঠিক দিক নির্দেশনায় দুঃখ মুক্তির পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। বুদ্ধের সাক্ষৎ শিষ্যরা বুদ্ধের এক এক জন দিক্পাল হিসাবে আপন সাধনা বলে প্রতিষ্ঠিত হন। সদ্ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় প্রসন্নতা, পান্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা প্রদর্শনের ফলে মুক্তির পথ যাত্রী ভদন্তদের এক একটি অভিধায় অভিসিক্ত করেন। সমগ্র ত্রিপিটকে প্রায় ক্ষেত্রে মহামানব বুদ্ধকে সম্বোধন করা হতো “শ্রমণ গৌতম”, ভিক্ষু, স্থবির, মহাস্থবির ইত্যাদি বিশেষ অভিধায় সম্বোধন করতে শাস্ত্রে দেখা যায় না।
বুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গুণী, শাস্ত্রজ্ঞ, প্রাজ্ঞ-পন্ডিত ভিক্ষু-সংঘ সদ্ধর্মের র্দীঘ স্থায়িত্বের চিন্তা চেতনার ফসল একে একে ছয়টি সংগীতি বা সংঘায়ন সম্পন্ন করেন। সব সংগীতিতে প্রাধান্য পেয়ে ছিলেন ত্রিপিটক শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ পান্ডিত এবং ধর্ম-বিনয়ে উন্নত ভিক্ষু সংঘরা, যাঁদের সুচিন্তিত মতামত যথাযোগ্য আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
কতো চড়াই উৎড়াই, উত্তান পতনের মধ্যদিয়ে সদ্ধর্মের আলো আজো দেদ্দীপ্যমান। বুদ্ধ বির্দ্বেষী রাজন্যবর্গ যতবারই এত বিশাল বিশাল শিক্ষা-সংস্কৃতির সুতিকাগার মাটি চাপা দিয়েছে, ততই সমগ্র বিশে^ চড়িয়ে পড়েছে বুদ্ধের অনুসারীগণ, অথচ বুদ্ধ জীবনের সবই এশিয়ার মধ্যে, কিন্তু আজ মহামানব বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন সমগ্র বিশ^ব্রহ্মান্ডে শান্তির ললিত বাণীতে উদ্বুদ্ধ, শান্তিপ্রিয় মানুষ যুদ্ধ চায় না, তারা চায় পারিবারিক শান্তি, সামাজিক শান্তি, রাষ্ট্রীয় শান্তি ও বিশ^শান্তি। এই শান্তির পদ প্রদর্শক জগৎবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন ভোগে দুঃখ, ত্যাগে শান্তি, ত্যাগে পরম সুখ। তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত “রাজকুমার সিদ্ধার্থ”, একমাত্র রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার পরও তা তুচ্ছ মনে করে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনাবলে বোধিকে জাগ্রহ করে বুদ্ধত্ব জ্ঞানে জ্ঞানী হলেন। রাজা হলে, রাজসিংহাসনের অধিকারী হলে, মহাভারতের অন্যান্য রাজা মহারাজাদের তালিকায় নামটা লিপিবদ্ধ হতো, আজ বিশ^বাসী শ্রদ্ধা সম্মানের সাথে তাঁর নাম উচ্চারণ করছে। ভোগ অতিব সহজ, ত্যাগের মহিমায় নিজেকে সমর্পন করা কঠিন, কঠিন কাজটি তিনি করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি সর্বজ্ঞ, তাই তিনি সবার প্রণম্য।
পরম্পরা মহান ভিক্ষু সংঘের ত্যাগে এখনও পৃথিবীর চারদিকে সদ্ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম ঘুরে বা দেখে অনুমান করা সম্ভব নয়, বুদ্ধের মৈত্রীর বাণী কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত লাভ করেছে। আমরা অন্যকে না জেনে নিজেকে মহৎ এবং বৃহৎ মনে করি। থেরবাদী বা হীনযান চর্চ্চা কারীর চেয়ে বিশে^ এখন মহাযানী বা মহায়ানা চর্চ্চা কারীর সংখ্যা অনেক বেশী এবং তাঁরা ধ্যানে, জ্ঞানে, প্রচারে প্রসারে খুবই সমৃদ্ধ। মহাযান ধর্ম-বিনয় কোন অংশে সহজ নয়, এক এক দেশে এক এক রকম ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের ধর্মীয় বসন, তাঁদের মত তাঁরা কঠোর কঠিন ধর্ম-বিনয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। আমাদের মত ২০ বৎসর বয়স হলে ভিক্ষু, ভিক্ষু জীবনের ১০ বৎসর হলে স্থবির আবার ২০ বৎসর গত হলে মহাস্থবির, আবার কোন কোন সংস্থা থেকে কত বিশাল বিশাল উপাধি ও বিশেষণ, ব্যক্তির কাজের সাথে, বিশেষণের কোন সামজস্য সাড়া বৎসর খুঁজে বের করা যাবে না, আবার পোষ্টার, চিঠিতে ও সভা-সমিতিতে বিশেষণ গুলো উপস্থাপক উল্লেখ না করলে বিশেষ ব্যক্তি খুবই মনে কষ্ট পায়, আবার কোন কোন জন নিজের হাতে লিখে দেন, যেন সব টাইটেল বলা হয়। সাধারণ মানুষের চাইতে যারা অসাধারণের পথে যাত্রা করেছেন, বক্তব্যে আপনাকে নাম-রূপ ধ্বংস করার উপদেশ প্রদান করেন তাঁদের কারো কারো মধ্যে এই মোহটি বেশী করে পরিলক্ষিত হয়, যা বিজ্ঞ জন কর্তৃক নিন্দিত হয়। মহাযানী সম্প্রদায়ের ভিক্ষু ভিক্ষুণীদেরকে অবশ্যই প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে পরীক্ষা দিয়ে বিশেষ উপাধি অর্জন করতে হয়। বিশে^র অনেক মানুষ বাংলাদেশ চিনে না, যখন উনি জানবেন আপনি বুড্ডিষ্ট তখনই আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মহর্ষি দালাইলামাকে চিনেন? অথচ ধ্যান-জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি কিছুই আমার নেই, আমার আছে অহংকার, অহমিকা, আমিত্ব ও বাহারী টাইটেল। বুদ্ধের সম্যক পথ থেকে কেন জানি অনেক দূরে চলে গেলাম।
তৎকালীন প্রাতঃস্মরণীয় আচার্যদের নাম উচ্চারণ করতে মাথা নত হয়ে যায়। আজ আমরা অনেকে গুরুবাদ ও কূলবাদ দোষে দুষ্ট। ব্দ্ধু অনন্ত জন্মের সাধনায় জগতে আলোর মশাল প্রজ¦লিত করেছিলেন, জগতের সর্ব প্রাণীর দুঃখ মুক্তির প্রত্যাশায়। তিনি পরিনির্বাপিত হওয়ার সময় একক কারো হাতে এই আলোর মশাল না দিয়ে মহান সংঘের হাতে তুলে দিয়ে ছিলেন, আজ সেই আলোর মশালের আলো নেই। হাতে আছে সেই মশালের লাঠি। বুদ্ধ কোন ভিক্ষু চেয়ে ছিলেন, এখন আমি/আমরা কোন ভিক্ষু, যারা বুদ্ধের নামে, দানে, দক্ষিণায় প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছি।
আজকাল অনেক দায়ক দায়িকা বলতে শুনা যায়, আমাদের বিহারের ভন্তে, অমুক অমুক ভন্তেকে আমাদের সংঘদানে আমাদের গ্রামে ফাং না করার জন্য বলেছেন, আবার অন্য কোন গ্রামে আমাদের ভন্তেও যাদেরকে ফাং করার জন্য নিষেধ করেছেন উনারাসহ ধর্মসভায়, সংঘদানে ও সীমাঘরে ধর্ম-বিনয়ের কাজ একসাথে বসে করছে। আমরা কি অপরাধ করেছি ভন্তে? আপনারা যারা আমাদেরকে অহিংসা-শান্তি ও মৈত্রীর বাণী চর্চ্চা করার জন্য শিক্ষা দিয়ে থাকেন, আপনাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এর চর্চ্চা কোথায় ভন্তে? একদিন আমাদের সমাজ সদ্ধর্মের বিশাল অবস্থা সম্পন্ন একজন মহান ভিক্ষুর মুখে শুনতে পেয়েছিলাম, “একটু অপেক্ষা কর, আমি দেখিয়ে দেব এই এলাকাকে খানখান করে ফেলব”! সত্যিই তিনি অনেকটা সফল। কোন কোন ভিক্ষু ও কোন কোন স্থানীয় ভিক্ষু সংগঠনের ভূমিকা যদি এই হয় তা হলে সাধারণ শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকারা কয়েক জন ভিক্ষুর আচার-আচরণের কারণে বৃহত্তর ভিক্ষু সংঘের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, তা আস্তে আস্তে সংক্রমিত হতে থাকবে। এদেশের জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা একেবারে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, তার মধ্যে দু’টি নিকায়, রাষ্ট্র ও সরকার তা জানে, আরো জানে বৌদ্ধদের অসংখ্য সংগঠন, কেউ কারো কথা মানে না। এই অবস্থায় যারা দিকনির্দেশনা দেবে তারা নিজেদের মধ্যে এত বিশৃংখলা হলে, এই তপ্ত হৃদয়ে শান্তির পরশ দিয়ে কে শুনাবে বুদ্ধের অমৃত বাণী। প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুত্ব জীবনের প্রতিজ্ঞা যা ছিল, হয়ত শতভাগ রক্ষা সম্ভব নাই বা হলো! কিন্তু সাধারণের মানদন্ডে, অবশ্যই অসাধারণ হওয়া প্রয়োজন। প্রাতঃস্মরণীয় পুণ্যপুরুষ পন্ডিত প্রজ্ঞাতিষ্য মহাথেরো মহোদয়ের জীবনে যা অর্জন সবই কঠিন পরিশ্রমের ফসল। বর্তমানের বিশেষ বিশেষ অভিধা ধারণকারীদের যা প্রচার প্রসার বিশেষণ, সে সময়ের আরাধ্য জনের সেই কামনা বাসনা কখনো ছিল না, তাঁদের শ্রদ্ধা আগ্রহ ছিল বুদ্ধের প্রদর্শিত মূল, ধর্ম-বিনয়ের মধ্যে থেকে সাধনামার্গে অগ্রসর হওয়া। এখনও শাসনধ্বজ পন্ডিত প্রজ্ঞাতিষ্য মহাথেরো আপন আলোয় উদ্ভাসিত, সদ্ধর্মের আলোয় সর্ব সাধারণের হৃদয়ে পূজ্য প্রজ্ঞাতিষ্য মহাথেরো চির অম্লান। পূজ্য ভন্তের পরবর্তী সময়ে তালসরা মুৎসুদ্দিপাড়া বিবেকারাম বিহার তাঁর সাধন পীঠ সংস্কার, পুণঃনির্মাণের কাজে অনেক পূজনীয় ভিক্ষু সংঘ ও নিবেদিতপ্রাণ দায়ক-দায়িকা এগিয়ে এসেছেন, আজকের জয়ন্তী নায়ক আমার পরম শ্রদ্ধার অগ্রজ ভদন্ত, শাসনমিত্র মহাথেরো মহোদয়ের নাম অনন্য। পন্ডিত ভন্তের স্মৃতি ধন্য সাধন ধামে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চৈত্য সেবা, পূজা, বন্দনায় দীর্ঘ সময় নিজেকে সমর্পণ করেছেন, ধন্য পূজ্য সুবর্ণ জয়ন্তী নায়ক। ভাল কাজের, ভাল ফল অবশ্যই আসবে। এই পুণ্যময় তিথিতে আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে আপনার চরণ বন্দনা করছি। আপনি পন্ডিত ভন্তের সাধনপীঠ রক্ষার যোগ্য উত্তরসুরী। সপ্তগ্রাম ভিক্ষু সমিতি, সপ্তগ্রামের দায়ক-দায়িকাও সমগ্র বিশে^ এই পুণ্যতীর্থের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন ও আপনার গুণ-গ্রাহী ভক্ত বিরাজমান। আজ একজন যোগ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হল। এসবের পরও কেন জানি বলতে ইচ্ছে করছে, আপনার তুলনা আপনিই।
“সকলের মধ্যে প্রজ্ঞাচক্ষু উৎপন্ন হউক”।

Leave a Reply